শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর

গোপালগঞ্জ জেলার কাশীয়ানী উপজেলার অন্তগত সাফলিডাঙ্গা একটি গ্রাম।এই গ্রামেই জন্মগ্রহন করেন হরিচাঁদ ঠাকুর।বাংলা ১২১৮ সনের (১৮১১ খ্রিষ্টাব্দ) ফাল্গুন মাসে।সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের তিথি।

হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতার নাম যশোমন্ত ঠাকুর এবং মাতা অন্নপূর্ণা দেবী।যশোমন্ত ছিলেন মৈথিলী ব্রাক্ষণ এবং নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব।হরিচাঁদ যশোমন্তের দ্বিতীয় পুএ।তাঁর অপর তিন ছেলের নাম যথাক্রমে  বৈষ্ণব দাস, গৌরী দাস ও স্বরূপ দাস।এরা সকলেই ছিলেন  বৈষ্ণব।

হরিচাঁদ ছিলেন খুবই মেধাবী।কিন্তু বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা পাঠ তাঁর ভালো লাগেনি।তাই মাএ কয়েক মাস গিয়ে তিনি বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।মিশে যান রাখাল বন্ধুদের সঙ্গে।তাদের সঙ্গে গোচারণ করেন।খেলাধুলা করেন।কখনো বা গান করেন।তাঁর গানের গলা ছিল খুবই মধুর।তাই তাঁর গান, ভজন, র্কীতন শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।তাঁর চেহারাও ছিল খুবই সুন্দর।ব্যবহার ছিল অমায়িক।এসব কারণে সবাই তাঁকে পছন্দ করত।রাখাল বন্ধুরা তাঁকে বলত, রাখাল রাজা।

হরিচাঁদ ঠাকুর ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রতৃতির।বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এ বিষয়টি তাঁর মধ্যে আরো প্রকট হয়।তিনি ক্রমশ ধর্মের দিকে চলে যান।তবে তিনি নতুন কোনো ধমমত প্রচার করেন নি।তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যর হরিনাম প্রচার করেন।তিনি বলেছেন, ভক্তির সঙ্গে হরির নাম নিলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে।এই নাম সংর্কীতনই হচ্ছে তাঁর সাধন-ভজনের পথ।তিনি এই হরিনামে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন।এজন্য তাঁর এই সাধনপথের নাম হয় মতুয়া।আর তাঁর অনুসারীদের বলা হয় মতুয়া সম্প্রদায়।

মতুয়াবাদের মূল কথা হলো মনুষ্যত্ব অজন, আত্নোন্নতি এবং সার্বিক কল্যাণ সাধন।সত্য, প্রেম ও পবিএতা-এই তিনটি স্তম্ভের ওপর মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠিত।সাধনার লক্ষ্য সত্যদশন বা ঈশ্বরলাভ।এজন্য চাই প্রেম।প্রেমের পূবশত হচ্ছে পবিএতা।

পবিএ দেহ-মনের প্রেমের উদয় হয়।

তখন ভক্তের অন্তরে জাগ্রত হন প্রেমময় হরি।হরিচাঁদ ঠাকুর হরিনামের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অবহেলিত সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করেন।

তিনি বলতেন,

দল নাই যার, বল নাই তার।

এর ফলে মতুয়াবাদ এক বিরাট আন্দোলন পরিণত হয় এবং মতুয়া সম্প্রদায় ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সবত্র।

ঠাকুর বলতেন, ধমচর্চার জন্য সংসার ত্যাগ করতে হয় না।সংসারে থেকে সংসারের কাজ করেও ধমচর্চা করা যায়।তাঁর নিদেশ ছিল, হাতে কাম, মুখে নাম।তিনি নিজেও সংসারী ছিলেন।তাঁর দুই পুএ ও তিন কন্যা ছিলেন।পুএরা হলেন গুরুচরণ ও উমাচরণ।ঠাকুরের অন্তঃর্ধানের পর গুরুচরণই গুরুচাঁদ নামে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধানরূপে পূজিত হণ।মতুয়া সম্প্রদায় হরিচাঁদ ঠাকুরকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে জ্ঞান করেন।

তাই তাঁরা বলেন,

রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ।

সব হরি মিলে এই পূণ হরিচাঁদ।।

ঠাকুরের মতুয়াবাদে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধম-বণ এসবের কোনো ভেদ নাই।যে-কেউ হরিনাম সংর্কীতনে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

মতুয়া সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র গোপালগজ্ঞের ওড়াকান্দিতে।সাফলিডাঙ্গা গ্রামের পাশে।সেখানে প্রধান হরিমন্দির অবস্থিত।বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হরিমন্দির আছে।২০১০ সনে ঢাকার রমনা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে একটি হরিমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।প্রতিবছর চৈএ মাসের কৃষ্ণপক্ষের এয়োদশী তিথিতে ওড়াকান্দিতে মহাবারুণি স্নান অনুষ্ঠিত হয়।তিনদিন পযন্ত মেলা বসে।হাজার-হাজার লোকের সমাগম ঘটে ঐ স্নান ও মেলায়।তাঁরা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

বাংলা ১২৮৪ সনের  (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) ২৩ শে ফাল্গুন ৬৬ বছর বয়সে হরিচাঁদ ঠাকুর ইহলীলা সংবরণ করেন।ঠাকুরের জীবন ও আদশ নিয়ে কবিয়াল তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেছেন শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হরিমন্দিন মতুয়াসহ ভক্তরা নিয়মিত নাম র্কীতন করেন এবং হরিচাদ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

ঠাকুরের কয়েকটি বাণী::

১.হরি ধ্যান হরি জ্ঞান নাম সার।

প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।।

২.জীবন দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।

ইহা ছাড়া আর যত হব ত্রিয়া ভ্রষ্টা।।

৩.গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়।

সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।।

৪.গৃহকম গৃহকম করিবে সকল।

হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।।

র্গাহন্থ্য তোমার ধম অতি সনাতন।

দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন।।

হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুসারিদের বারটি উপদেশ দিয়েছেন, যেগুলো  দ্বাদশ আজ্ঞা নামে পরিচিত।এই আজ্ঞাগুলো সবাই জন্যই পালনীয়।

আজ্ঞাগুলো হলো::

(১) সদা সত্য কথা বলে।(২)পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।(৩)নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে।(৪)জগৎকে প্রেম করবে।(৫)সকল ধর্মে উদার থাকবে।(৬)জাতিভেদ করবে না।(৭)হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে।(৮)প্রত্যহ র্প্রাথনা করবে।(৯)ঈশ্বরে আত্নদান করবে।(১০)বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না।(১১)ষড়রিপু বশে রাখবে।(১২)হাতে কাম, মুখে নাম করবে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *