হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক

হিন্দুধর্ম অতি প্রাচীন ধর্ম। হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম ও বলা হয়৷ এই ধর্ম প্রতীকতায় সমৃদ্ধ। 

আর এই সব চিহ্ন বা প্রতীকের অনেক বিশেষত্বও রয়েছে। প্রত্যেক চিহ্নের রয়েছে আলাদা আলাদা মানে। আবার সেগুলির প্রভাবও আলাদা। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এগুলির প্রভাব রয়েছে। আজ আপনাদের জানাবো সেই সব প্রতীক বা চিহ্ন সম্পর্কে। 

১. ওম (ওঁ)

হিন্দু ধর্মের জন্য একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র স্বীকৃত প্রতীক হলো ওম। ওম হল পবিত্র  প্রতীক যা বিশ্বজগতকে প্রতিনিধিত্ব করে। 

আবার এটি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সংঘটনকারী ঈশ্বরের ও প্রতীক। 

 ওম কার এমন এক শক্তি যা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, ভক্তবাঞ্ছাপূর্ণকারী ও জ্ঞানপ্রদাতা। ওম কারকে ত্র্যক্ষরও বলা হয় কারণ ওম তিনটি মাত্রাযুক্ত বর্ণ (অ+উ+ম) সমন্বয়ে গঠিত। 

 অ-কার ‘আদিমত্ত্ব অর্থাৎ প্রারম্ভের প্রতীক। উ-কার উৎকর্ষ বা অভেদত্ব এর প্রতীক। ম কার অপীতি অর্থাৎ লয়ের প্রতীক। 

এই  ত্র্যক্ষর হিন্দুধর্মের পবিত্রতম ও সর্বজনীন প্রতীক।  স্বামী বিবেকানন্দের মতে ওম কার সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক এবং ঈশ্বরেরও প্রতীক।

ওম কার ঈশ্বরের সকল নামের প্রতিনিধিস্বরূপ ও তার শ্রেষ্ঠ নাম। বেদ, উপনিষদ, গীতা ও অন্যান্য শাস্ত্রে ও সর্বত্রই ওম কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অথর্ববেদের গোপথব্রাহ্মণের একটি কাহিনি অনুযায়ী,  দেবরাজ ইন্দ্র ওম কারের সহায়তায় দৈত্যদের পরাস্ত করেছিলেন। 

 ওম কার বারংবার উচ্চারণের মাধ্যমে  মানুষ তার পাশব প্রবৃত্তি জয় করতে সমর্থ হয়।

 মুণ্ডক উপনিষদে ওম কার অবলম্বনে ঈশ্বরোপাসনার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও  শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, তিনি সকল অক্ষরের মধ্যে ওম কার। মৃত্যুকালে ওম কারের উচ্চারণে পরম সত্য লাভ হয়ে থাকে। 

২. কালচক্র

কালচক্র সময়ের চাকা বা সময়ের বৃত্ত হিসেবে পরিচিত। কালচক্রে  আটটি মুখপাত্র রয়েছে যা সময়ের নির্দেশকে চিহ্নিত করে এবং প্রত্যেকেই কোনও দেবতার দ্বারা শাসিত হয় ও একটি অনন্য গুণ রয়েছে।কালচক্রের এই শক্তিশালী প্রতীক পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নিরাময় এবং শান্তি দেয়। 

৩. স্বস্তিকা

স্বস্তিকা সাধারণ অর্থে কল্যাণ বা মঙ্গল বোঝায়। 

 সূর্য  সৌভাগ্য, সৃষ্টি এবং জীবনের প্রতীক, তাই সূর্যদেবতার সাথে স্বস্তিকার একধরনের সম্পর্ক টানতে চেয়েছেন অনেকেই। তবে সকল দিক অনুসারেই স্বস্তিকা শুভের চিহ্ন। 

হাজার হাজার বছর ধরে  গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে এই প্রতীকটি। 

স্বস্তিকা এর চার বাহু মূলত চারদিকে পর্যবেক্ষণরত চার মস্তকধারী পরমস্রষ্টা ব্রহ্মাকে নির্দেশ করে। স্বস্তিকা চিহ্নের কেন্দ্রে মিলিত হওয়া চারটি বাহু দ্বারা বোঝায় সৃষ্টিজগৎ এভাবেই পরম স্রষ্টার সাথে সংযুক্ত। 

আবার স্বস্তিকা চিহ্নের এই বাহুগুলো ঘড়ির কাঁটা অভিমুখে থাকলে ধনাত্মক স্বস্তিকা এবং বিপরীতে থাকলে ঋণাত্মক স্বস্তিকা হিসেবে মানা হয়। তবে সেক্ষেত্রে ধনাত্মক স্বস্তিকা বিষ্ণু ও সূর্যকে প্রকাশ করে এবং ঋণাত্মক স্বস্তিকা কালী এবং

অলৌকিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। ১১ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এই চিহ্ন। শাস্ত্র মতে, স্বস্তিকা  চিহ্ন দরজায় বা বাড়ির মূল প্রবেশ দ্বারে থাকা শুভ।

৪. শ্রীযন্ত্র

শ্রীযন্ত্র যেমন সংসারে লক্ষ্মীশ্রী বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তেমনি একইসঙ্গে এই যন্ত্র শিক্ষার্থীদের জ্ঞাণ, মানসিক শক্তি এবং একাগ্রতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে থাকে। শ্রীযন্ত্রের আরেক নাম যন্ত্ররাজ। কিন্তু এই যন্ত্র যে শুধু লক্ষ্মীলাভের সহায়ক এমনটা নয়, এই যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যার স্থানও বিশেষভাবে উন্নত করা যায় বলে মনে করা হয়। 

শ্রীবিদ্যা  হল একটি তান্ত্রিক মত, যে মতে মহাশক্তিকে ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি রূপে পূজা করা হয়। আবার এই রূপটির এক হাজার নাম পাওয়া যায় ললিতা সহস্রনাম স্তোত্রে।  এই মহান সাধনা দ্বারা  জাগতিক সমৃদ্ধি ও আত্ম-অনুসন্ধান উভয়ই করা সম্ভব। 

শ্রী যন্ত্র শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। বাস্তুশাস্ত্র মতে ঘরে স্ফটিক শ্রীযন্ত্র রাখা শুভ। এই শ্রীযন্ত্র গৃহস্থে খুব তাড়াতাড়ি সমৃদ্ধি এনে দেয়।

৫. নটরাজ

কথিত আছে নৃত্য ও সঙ্গীতের স্রষ্টা শিব। তিনিই  নৃত্যকলার প্রর্বতক। নটরাজ বেশে শিবের মূর্তি খুবই জনপ্রিয়।

শিব যখন ক্ষিপ্ত হন ঠিক তখনই তার এই রূপ প্রকাশ্যে আসে৷ শিবের মূর্তির মধ্যে ধ্যানমগ্ন অবস্থা বা মায়াসুরের পিঠে তাণ্ডবনৃত্যরত অবস্থার মূর্তি যা নটরাজ মূর্তি নামেই বেশি প্রচলিত।

সহস্রনামে শিবের নর্তক এবং নিত্যনর্ত নামদুটি পাওয়া যায়। পৌরাণিক যুগ থেকেই নৃত্য এবং সঙ্গীতের সঙ্গে শিবের যোগ বিদ্যমান।

সমগ্র ভারতে, বিশেষ করে তামিলনাডুতে নটরাজের নিকটবর্তী নৃত্যমূর্তি নামক শিবের নানান নৃত্যরত মূর্তি পাওয়া যায়। শিবের সাথে সম্পর্কযুক্ত দুটি নৃত্য  হল তাণ্ডব এবং লাস্য। তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক ও পুরুষালি নৃত্য। শিবই কাল মহাকাল বেশে বিশ্বধ্বংসের উদ্দেশ্যে এই নাচ নাচেন। আবার লাস্য মধুর ও সুচারু নৃত্যকলা।  এই  নৃত্যকে পার্বতীর নাচরূপে কল্পনা করা হয় তবে লাস্যকে তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প বলে ধরা হয়।তাণ্ডব এবং লাস্য নৃত্য যথাক্রমে ধ্বংস ও সৃষ্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

৬. শিব লিঙ্গ

শিবলিঙ্গ  হল পরমেশ্বর শিবের নির্গুণ ব্রহ্ম সত্বার  প্রতীকচিহ্ন। ধ্যানমগ্ন শিবকে এই প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় এবং মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গে শিবের পূজা হয়।শিব অর্থাৎ মহাদেব আত্মধ্যানে স্ব-স্বরূপে লীন থাকেন। এবং সব মানুষকেও আত্মনিমগ্ন তথা ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন।  শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা  ত্রিপুণ্ড্র নামে পরিচিত। শিবলিঙ্গ ৩টি অংশ নিয়ে গঠিত। সবার নিচের অংশকে বলা হয় ব্রহ্ম পিঠ এবং মাঝখানের অংশ বিষ্ণুপিঠ আর সবার উপরের অংশকে বলা হয় শিব পিঠ। তবে একটি  তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এবং এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।

৭. নাগা

 নাগা  হলো কুণ্ডলিনী শক্তি এবং মহাজাগতিক শক্তি। প্রাচীন কাল থেকেই নাগা সর্প উপাসকদের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। নাগা এবং স্ত্রীলিঙ্গ নাগিন উভয়ই  বহুলভাবে উপাসনা করা হয়। বিশেষ নাগা মন্দিরে সাপগুলি অন্যান্য দেবদেবীদের মতো রাখা এবং পুজো করা হয়। নাগা বা সাপের উপাসনা  জীবন ও সময়কে ঘিরে । এটি মূলত পুনরায় জন্ম ও মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করে।  সাপগুলি মূল শক্তি এবং নিরাময়ের প্রতীক। অনেক সমাজে, সর্পগুলিকে ঘরের অভিভাবক হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং তারা এটা বিশ্বাস করে যখন একটি সাপ জীবনে প্রবেশ করে, তখন  থেকে সৃজনশীলতা এবং প্রজ্ঞার সময় শুরু হয়।

৮. বট গাছ

বটগাছ সাধারণত মন্দিরের সামনে রোপণ করা হয়। এটি হিন্দু ধর্মের প্রতীক এবং ঐশ্বরিক স্রষ্টা ব্রহ্মাকে উপস্থাপন করে। বটগাছ অন্যতম একটি   পূজিত গাছ। এই গাছ ত্রিমূর্তির প্রতীক হিসাবে ও বিশ্বাস করা হয়। এই গাছ বহু শতাব্দী ধরে বহু শিকড় থেকে বেঁচে থাকার এবং বেড়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।  বলা হয় যে, শিব এবং ঋষিরা আলোকপাতের জন্য তার ছায়ায় বসেছিলেন। আবার পুরাণ মতে, এই গাছের কান্ডগুলিতে দেবতার আবাস। ধর্মগ্রন্থেও অমরত্বের বৃক্ষ হিসাবে বর্ণিত আছে বটবৃক্ষ। 

৯. পদ্ম ফুল

 পদ্ম  শিষ্টাচার এর প্রতীক। এটি সৃষ্টি, এবং সিদ্ধির প্রতীক। এছাড়াও বিষ্ণু, ব্রহ্মা এবং লক্ষ্মীর সঙ্গেও সম্পর্কিত পদ্ম ফুল। পদ্ম পুষ্পটি পবিত্রতার প্রতীক ও। পদ্ম নারায়ণের নাভি থেকে নির্গত এবং ব্রহ্মা সর্বদা পদ্মের উপরে ধ্যান করেন।  বিষ্ণু, গণেশ এবং পার্বতীর হাতেও পদ্ম দেখা যায়। এই প্রতীকটি  বিভিন্ন মন্দিরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং যানবাহন দেখা যায়।  

১০. তিলক

তিলক কপালে পরা হয়। চন্দন দিয়ে সাধারণত এই তিলক পরা হয়।  তিলক আসলে জ্ঞানের চোখ খুলে দেয়। শিবের তৃতীয় নেত্র যেখানে থাকে সেখানেই তাই আঁকা হয় তিলক অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে রাখতে হয় এই তিলক। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *