শ্রীরামকৃষ্ণ

সকল ধমই সত্য, যত মত তত পথ, অথাৎ ধর্মীয় মত ও পথ ভিন্ন হলেও সকল মানুষের উদেশ্য ও গন্তব্য এক-ঈশ্বরলাভ।এই পরম সত্যটি যিনি উপলদ্বি করেছিলেন তিনি প্রধাগত শিক্ষায় ছিলেন না।তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত।স্বোপার্জিত জ্ঞান দ্বারা ধর্মের এই মূলতও্ব তিনি উপলদ্বি করতে পেরেছিলেন।ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার অর্ন্তগত কামারপুর গ্রামে তাঁর জন্ম—১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি।তাঁর পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা নাম চন্দ্রমণি দেবী।পিতা-মাতা বিষ্ণুর অপর নামানুসারে শিশুপুএর নাম রাখেন গদাধর।এই গদাধরই পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নামে জগদ্বিখ্যাত হন।

বালক গদাধর দেখতে ছিলেন খুবই সুন্দর এবং প্রকৃতিপ্রেমী।প্রাকৃতির দৃশ্য দেখতে কিংবা আকাশে উড়ন্ত  বলাকার ঝাঁক দেখে মাঝে মাঝে তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়তেন।এটা ছিল তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।কিন্তু স্কুলের লেখাপড়ায় তাঁর মন ছিল না একেবারেই।তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।তবে তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর।একবার কিছু শুনলেই মুখস্ত বলতে পারেন।এভাবে তিনি পিতার কাছ থেকে শেখেন ধর্মীয় শ্লোক ও স্তব-স্তোব, গ্রামের কথকদের কাছ থেকে শেখেন রামায়ণ-মহাভারত এবং পুরীগামী র্তীথযাএীদের কাছ থেকে শেখেন ধমনিতি।ভজন-র্কীতনের প্রতি তাঁর খুব আকষণ ছিল।এভাবে গদাধর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন শাসেএ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

গদাধরের অল্প বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।পিতার মৃত্যু পর তাঁর জীবনে এক অদ্ভুত পরিবতন আসে।তিনি কখনও শ্নাশানে গিয়ে বসে থাকেন।কখনও বা র্নিজন বাগানে গিয়ে সময় কাটান।সাধু-বৈষ্ণবদের দেখলে কৌতূহল ভরে তাঁদের আচরণ লক্ষ করেন।তাঁদের নিকট ভজন শেখেন।এ অবস্থায় অগ্রজ রামকুমার তাঁকে কোলকাতায় ‍নিয়ে যান।সেখানে ঝামাপুকুরে অবস্থিত নিজের টোলে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন।কিন্তু গদাধরের মনের কোনো পরিবতন হয় না।আগেই মতোই লেখাপড়ায় তিনি উদাসীন থাকেন।

এমন সময় রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে রামকুমার দক্ষিণেশ্বরে আসেন।গদাধরও তাঁর সঙ্গে আসেন।মা-কালীর বিগ্রহ এবং পুর্জাচনা দেখে খুবই আনন্দিত হন।তিনি যেন এতদিন এমন একটা কিছুই চেয়েছিলেন।তাই কখনও তিনি মায়ের মন্দিরে ভাবতন্ময় হয়ে থাকেন, কখনও বা আত্নামগ্ন অবস্থায় গঙ্গার তীরে ঘুরে বেড়ান।

হঠাৎ একদিন অগ্রজ রামকুমারের অকালমৃত্যু হয়।ফলে মায়ের পূজার ভার পড়ে গদাধরের ওপর।মনেপ্রাণে তিনিই মায়ের পূজা আরম্ভ করেন।মায়ের পূজায় ভক্তিগীতি গাওয়ার সময় প্রায়শই তিনি অচেতন হয়ে পড়তেন।কালক্রমে এখানেই কালীসাধনায় তাঁর সিন্ধিলাভ ঘটে।তিনি এী সারদা দেবীকে আধ্যাত্নিক জ্ঞান দান করেন, যা অচিরেই তাঁকে আধ্যাত্নিক জননী পদে উন্নীত করে।এভাবে গদাধর সবব্যাপিণী চৈতন্যরূপিণী দেবীর দশন লাভ করেন।

১৮৫৫ সনে গদাধর মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত হন।এতে তাঁর কালীসাধনার সুবণ সুযোগ ঘটে।এর ছয় বছর পর ১৮৬১ সালে সিন্ধা ভৈরবী যোগেশ্বরী দক্ষিণেশ্বরে আসেন।গদাধর তাঁকে গুরু মানেন এবং তানিএক সাধনায় সিন্ধিলাভ করেন।এই অসামান্য যোগী এবং অবতার পুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন ভৈরবীই গদাধরকে।

এরপর গদাধরের সাধন জীবনে আসেন সন্ন্যাসী তোতাপুরী।তিনি গদাধরকে বেদান্ত সাধনায় দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নাম রাখেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস।শ্রীরামকৃষ্ণ একই সঙ্গে বৈষ্ণব সাধনায়ও সিন্ধিলাভ করেন।

রামকৃষ্ণ শুধু হিন্দু ধমমতভিওিক সাধনায়ই আবদ্ব থাকেন নি।তিনি ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধমমতেও সাধনা করেছেন।এভাবে বিভিন্ন ধম সাধনার মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে উপলন্ধি করেছেন।তাঁর মতে সকল ধর্মেই জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে উপলন্ধি করা।ধমসমূহের পথ ভিন্ন হলেও সকলেরই উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা।

তাই তিনি উদার কন্ঠে বলেছেন,

সকল ধমই সত্য, যত মত তত পথ,।

তিনি প্রথাগত সন্ন্যাসীদের মতের সঙ্গে একমত ছিলেন না বা তাঁদের মতো পোশাকও পরতেন না।এমনকি তিনি এী সারদা দেবীকে সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে পূজা করতেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন লোকগুরু ।ধর্মের জটিল তও্ব ‍তিনি গল্পের মাধ্যমে সহজ করে বোঝাতেন।ঈশ্বর রয়েছেন সকল জীবের মধ্যে, তাই জীবসেবাই ঈশ্বরসেবা-এই ছিল তাঁর দশন।ধর্মীয় সম্প্রীতিতে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন।তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁরই ধর্মীয় আদশ জগদ্বাসীকে শুনিয়ে গেছেন, যার ফলে তাঁর এই জীবসেবার আদশ অর্থাৎ মানবধম আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।বিবেকানন্দ তাঁর গুরুদেব সম্পর্কে বলেছেন, তিনি যেমন জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে।এখন থেকে সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচন্ডাল প্রেম পাবে।মেয়ে-পুরুষ-ভেদা, ধনী-নিধনের ভেদ, ব্রাক্ষণ-চন্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধন-দশনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।ফলে অনেক জ্ঞানী-গুনী দক্ষিণেশ্বরের আসতে থাকেন।তাঁর উদার ধর্মীয় নীতির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবাদর্শে  মোহগ্রস্ত অনেক শিক্ষিত যুবক ভারতীয় আদর্শে ফিরে আসেন।তিনি যেমন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে যেতেন, তেমনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবগও তাঁর নিকট সংস্পর্শে এসেছিলেন।ফরাসি মনীষী রমাঁরলাঁ বিবেকানন্দের কাছ থেকে শুনে এতটাই প্রভাবিত হন যে, তিনি রামকৃষ্ণ সম্পর্কে এক বৃহদাকার গ্রন্থ রচনা করেন।

পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী শুধু মুখের কথা নয়, সেগুলো তাঁর জীবনচর্চায় রূপায়িত সত্য।তিনি অহংকারশূন্য হয়ে জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা করেছেন।দরিদ্রদের দেখলে তাঁর মন কাঁদত।একবার তিনি র্তীথ দশনে যাচ্ছিলেন।সঙ্গে রানি রাসমণির জামাতা মথুরবার।তাঁরা যেন দেওঘরে।গ্রামের দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুদর্শা দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ মনে খুব ব্যথা পেলেন।তিনি মথুরবাবুকে বললেন দরিদ্রনারায়ণের সেবাই ব্যবস্থা করতে।মথুরবাবু তাই করলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন কালীর সাধক।কালীমূর্তিতে তিনি পূজা দিতেন।এর মধ্য দিয়েই তিনি মায়ের সাধনা করতেন।তাই বলে মূর্তি পূজার বিরোধী ব্রাক্ষধর্মের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না।ব্রাক্ষসমাজের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পক।কেশবচন্দ্রই প্রথম তাঁর বিভিন্ন বও্বতা এবং তাঁর সম্পাদিত পএীকার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা প্রচার করেন।এ থেকে বোঝা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ কতটা পরমতসহিষ্ণু ছিলেন।তাঁর সাধন-প্রণালী এবং ধমচর্চার মধ্য দিয়ে সবধম সমন্বয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।এটা শ্রীরামকৃষ্ণের একটা বড় অবদান।

শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের জার্তি, কুল, মান, শিক্ষা, প্রতিপওি ইত্যাদি দেখতেন না।তিনি দেখতেন মানুষের অন্তর।তাই তাঁর কাছে উঁচু-নীচু সব শ্রেনির মানুষ আসত।তাইতো দক্ষিণেশ্বর মন্দির ছিল সবার জন্য উন্নুক্ত।

শ্রীরামকৃষ্ণ সকল নারীর মধ্যে জগন্নাতাকে দশন করতেন।নারীমাএই তাঁর কাছে ছিল সাতৃস্বরূপা।তাইতো নিজের এীকেও তিনি মাতৃজ্ঞানে পুজো করেছিলেন।জগতে এরূপ ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই।

যখন বাইরে লোকের সঙ্গে মিশবে, তখন সকলকে ভালোবাসবে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন।যেন এক হয়ে যাবে মিশে।রাখবে না বিদ্বেষভাব।ও সাকার মানে, মানে না নিরাকার, ও নিরাকার মানে, মানে না সাকার;ও হিন্দু, মুসলমান, ও খ্রিষ্টান-এই বলে কাউকে ঘৃণা করবে না।

শ্রীরামকৃষ্ণের এই যে উদার মনোভাব, এর দ্বারা  লোকজন দারুণভাবে ভারতের প্রভাবিত হয়েছেন।ধম-বণ নির্বিশেষে এসেছেন তাঁর কাছে।তাঁর অমৃত বাণী শ্রবণ করেছেন।অন্তরে পরম শান্তি পেয়েছেন।

শুধু ভারতীয়রাই নন, শ্রীরামকৃষ্ণের উদার ধমমত দ্বারা বিদেশীরাও বিমোহিত হয়েছেন।এক সময় রাশিয়ান অধ্যাপক শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (গসপেল অফ শ্রীরামকৃষ্ণ) পড়ে বলেছেন, এত উদার, এত বিশ্বজনীন, সবজনীন ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

ইজরাইলে একটি রামকৃষ্ণ সেন্টার হওয়া ইহুদী বলেছেন তিনিও তাঁর দেশে একটি রামকৃষ্ণ সেন্টার খুলতে চানএকজন আফ্রিকান বলেছেন।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাদ্বের ১৫ই আগষ্ট এই মহাপুরুষ পরলোক গমন করেন।তাঁর সাধনাস্থান দক্ষিণেশ্বর এমন অন্যতম র্তীথস্থান হিসেবে পরিগণিত।

শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকটি উপদেশ:;

১.পিতাকে ভক্তি কর, পিতার সঙ্গে প্রীতি কর।জগৎরূপে যিনি সবব্যাপী হয়ে আছেন, তিনিই মা।জননী, জন্মস্থান, বাপ-মাকে ফাঁকি দিয়ে যে ধম করবে, তার ধম ছাই হয়ে যাবে।

২.ব্রক্ষময়ী-স্বরূপা মা গুরুজন।মাকে দেখতে হবে যতক্ষণ মা আছে।

৩.ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিএ হয়।অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ হয়, পবিএ হয়।একমাএ ভক্তির দ্বারা জাতিভেদ উঠে যেতে পারে।ভক্তের জাতি নেই।ভক্তি হলেই দেহ, আত্না সব শুদ্ধ হয়।ভক্তি না থাকলে ব্রাক্ষণ ব্রাক্ষণ

নয়।ভক্তি থাকলে চন্ডাল চন্ডাল নয়।ভক্ত হলে চন্ডালের অন্ন ও খাওয়া যায়।

৪.ছাদের উপর উঠতে হলে মই, বাঁশ, সিঁড়ি ইত্যাদি নানা উপায়ে যেমন ওঠা যায়, তেমনি এক ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার অনেক উপায় আছে।প্রত্যেক ধমই সত্য।

৫.আন্তরিক হলে সব ধমের ভেতর দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।ঈশ্বরের কাছে নানা পথ দিয়ে পৌছনো যায়।যত মত তত পথ।

৬.সংসারের নিত্য-অনিত্য মিশে আছে।বালিতে-চিনিতে মেশানো পিঁপড়ে মতো ।চিনিটুকু নেবে পিঁপড়ে হয়ে ।

৭.ক্ষতি নেই জলে নৌকা থাকলে।ভেতরে যেন নৌকার জল না ঢোকে কিন্তু।তাহলে ডুবে যাবে নৌকা।

৮.তাঁর অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাব ঈশ্বর এক। সেই নামে ও সেই ভাবে ডাকলে দেখা যায়, যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভালো লাগে। ৯.ভক্তেরা তাঁকেই নানা নামে ডাকছে; এই ব্যক্তিকেই ডাকছে।এক পুকুরে চারটি ঘাট।হিন্দুরা জল নিচ্ছে একঘাটে, বলছে জল;মুসলমানরা আর একঘাটে নিচ্ছে, বলছে পানি, ইংরেজরা আর একঘাটে নিচ্ছে, বলছে ওয়াটার; আবার অন্য লোক একঘাটে নিচ্ছে,বলছে Aqua।এক ঈশ্বর তাঁর নানা নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *