প্রাচীন কালের ১০ জন বিখ্যাত মুনি ঋষির পরিচয়

১.বিশ্বামিত্র

মহর্ষি বিশ্বামিত্র ছিলেন প্রাচীন ভারতে একজন রাজা। তিনি কৌশিক নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি কুশান্যভ রাজার পুত্র গাধি’র সন্তান ছিলেন ।

গাধিরাজের মৃত্যুর পর বিশ্বামিত্র রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন।তার শতাধিক পুত্র ও অসংখ্য সৈন্য ছিল।

বশিষ্ঠ মুনির কামধেনুকে বিশ্বামিত্র সৈনিকদের সহায়তায় বলপূর্বক  কেড়ে নিতে চেয়েছিলো এবং এই  নিয়ে  বশিষ্ঠ মুনির সাথে ঝগড়া

 বিশ্বামিত্র বিষ্ণু’র ৭ম অবতার হিসেবে রাম-লক্ষ্মণকে নিজের আশ্রমে নিয়ে যান এবং পথে তাদেরকে বলা ও অতিবলা মন্ত্র দান করেন। তারপর  বিশ্বামিত্র দুই ভাইকে নিয়ে মিথিলা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং পথে গৌতম ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয়ে রামের সাহায্যে অহল্যার শাপ বিমোচন করান। পরে তারই সহায়তায় মিথিলায় স্বয়ংবর সভায় গেলে রাজকুমারী সীতা রামের গলায় মালা পড়ান . ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্র রচয়িতা। এটি এমন ধরনের মন্ত্র যা সকল ধরনের প্রার্থনায় উচ্চারিত হয় ।

২.ব্যাসদেব

ব্যাসদেব ছিলেন পরাশর মুনি ও সত্যবতীর পুত্র । যমুনানদীতে খেয়া নৌকার ভিতর পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হলে, সত্যবতী গর্ভবতী হন । পরে যমুনা‘র একটি দ্বীপে এঁর জন্ম হয় । যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম হয় দ্বৈপায়ন ।ইনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন । এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ‘ব্যাস’ নামে পরিচিত হন । জন্মের পরপরই ইনি তার মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন । এঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম ।  মহাভারতের মত এরকম হাজারও শ্লোকের রচরিতা ব্যাসদেব । মহাভারত হতে জানা যায় যে ইনি মহাভারত এর শ্লোক বলেন এবং গণেশ তা লিপিবদ্ধ করেন ।

৩.বাল্মীকি 

প্রথম জীবনে বাল্মীকি ছিলেন রাজপথের দস্যু ।নারদ তাকে রাম নাম জপ করতে শেখান। দস্যু সাধনায় বসেন এবং ছয় হাজার বছর সাধনা ক’রে ব্রহ্মের বরে কবিত্বশক্তি পান । সাধনাকালে তার দেহ বল্মীকের স্তুপে ঢেকে গিয়েছিল ব’লে তার নামকরণ হয় বাল্মীকি ।

রামায়ণ মহাকাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনিই এই কাব্যের রচয়িতা। তিনি রামায়ণ রচনা করেন । বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে ২৪,০০০ শ্লোক ছিল। এই রামায়ণ ছয়টি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। রামায়ণের উপজীব্য অযোধ্যার রাজকুমার রামের জীবনকথা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই মহাকাব্য রচিত হয়।সীতাকে বনবাসে পাঠালে সীতা দেবী বাল্মীকির নিকট আশ্রয় নেন এবং সীতার দুই পুত্র লব ও কুশকে অতি যত্নের সাথে লালন-পালন করাসহ শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং তাদেরকে স্বরচিত রামায়ণ পাঠ করে গান করাতে শিখালেন।

৪. বশিষ্ঠ 

ইনি সপ্তর্ষি হিসাবে পরিচিত। এঁর স্ত্রীর নাম অরুন্ধতী। এছাড়া বশিষ্ঠ অক্ষমালা নামক শূদ্রকন্যার প্রতি আসক্ত হয়ে তার সাথে মিলিত হন। বশিষ্ঠের সংস্পর্শে এসে ইনি পরমগুণবতী নারীরূপ লাভ করেছিলেন। এই ঋষির নামে উত্তর-পূর্ব আকাশে একটি তারা আছে।ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র এবং প্রজাপতি।দশরথ পুত্রকামনায় যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ  করেছিলেন, সে যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত হিসাবে বশিষ্ট দায়িত্ব লাভ করেন।

বশিষ্ঠ মুনি বিশ্বামিত্রের শতপুত্র কে ধ্বংস করেছিলেন।বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের চির শত্রুতে পরিণত হন, বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামক এক রাক্ষস বশিষ্ঠের একশত পুত্রের সকলকেই হত্যা করে খেয়ে ফেলে। সকলপুত্র হারিয়ে বশিষ্ঠ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর ইনি বিভিন্ন দেশে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ান। এইভাবে কিছুদিন কাটিয়ে ইনি দেশের দিকে রওনা দেন। চলার পথে পিছনে বেদ পাঠ শুনতে পেয়ে, পিছন ফিরে তার পুত্রবধূকে দেখতে পান। ইনি অবিলম্বে জানতে পারেন যে পুত্রবধূর গর্ভস্থ শিশু এই বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন। এরপর ইনি খুশি মনে পুত্রবধূকে সাথে নিয়ে আশ্রমের পথে রওনা হন। পরে যথাসময়ে পুত্রবধুর সন্তান হলে, নামকরণ করা হয় পরাশর।

৫. দুর্বাসা 

দুর্বাসা ঋষি প্রবল ক্রোধের জন্য পরিচিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত আখ্যান অনুসারে, দুর্বাসা ঋষির পিতা অত্রি এবং মাতা অনসূয়া। ঋষি দুর্বাসা শিবের অংশাবতার হিসেবেও খ্যাত। একবার ব্রহ্মা এবং শিবের কোনো এক কথাতে মনোমালিন্য হয়। এই সংঘাতের ফলেে শিব এত ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন যে, দেবতারা তাঁর ভয়ে পালাতে আরম্ভ করে। এই সংবাদে শিবের পত্নী পার্বতী ক্ষুন্ন হন এবং মহাদেবের সাথে বাস করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এটা  শুনে ঋষি অত্রির পত্নী অনুসূয়ার গর্ভে নিজর তপোগ্নি স্থাপন করেন। যেহেতু মহাদেবের ক্রোধের ফলে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেজন্য ঋষি দুর্বাসা সামান্য কথাতে ক্ষুন্ন হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন বলে জানা যায়।

৬.কশ্যপ 

কশ্যপ প্রাচীন আয়ুর্বেদ চর্চাকারী এক ঋষি যাকে বর্তমান মন্বন্তরের সপ্তর্ষির প্রথম হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়।  সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীনতম প্রার্থনাগাথা ঋগ্বেদ-রচয়িতা এই কশ্যপ ঋষি ।প্রজাপতি দক্ষ তার ১৩ কন্যা কশ্যপহস্তে সমর্পণ করেছিলেন । অদিতির থেকে আদিত্য এবং ইন্দ্র দেবের জন্ম হয়েছিল। দিতির থেকে রাক্ষসরা জন্মগ্রহণ করেছিল। এভাবে তার বংশের থেকে দৈব,দৈত্য, মানুষ, সাপ, পাখি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছে। ভগবান বিষ্ণু কশ্যপের স্ত্রী অদিতির ছেলে বামন অবতার হয়ে এসেছিলেন।

৭.ভরদ্বাজ

ভরদ্বাজ  প্রাচীন ভারতের অন্যতম সম্মানিত বৈদিক ঋষি ছিলেন, যিনি একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত, অর্থনীতিবিদ এবং বিশিষ্ট চিকিৎসকও ছিলেন। ভরদ্বাজ ছিলেন ব্রাহ্মণ যোদ্ধা দ্রোণাচার্যের জনক। বৈদিক গ্রন্থগুলিতে তাঁর পুরো নাম ভরদ্বাজ বৃহস্পত্যা, নামের শেষ অংশ থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি ঋষি বৃহস্পতির পুত্র। তাঁর মা ছিলেন উতথ্য ঋষির স্ত্রী মমতা। উতথ্য ছিলেন বৃহস্পতির বড় ভাই।

৮.জমদগ্নি

জমদগ্নি হলো সত্যবতী ও রিচিকের সন্তান ।এবং জমদগ্নির স্ত্রীর নাম রেণুকা দেবী । এই জমদগ্নিই হলেন পরশুরামের পিতা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট। একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে তিনি গন্ধর্বরাজ এর  স্ত্রীসহ জলবিহার করতে দেখেন এবং মোহিত হন। জল নিয়ে ফিরতে অনেক দেরি হয়। তাই দেখে ঋষি জমদগ্নি তপোবলে সবকিছু  জানতে পেরে খুব রেগে যান। এবং তার প্রথম ৪ পুত্রকে মাতৃ হত্যা করতে বলে কিন্তু তারা করে না।তিনি রেগে গিয়ে  তাদের প্রাণ নিয়ে নেন। তারপর  পুত্র পরশুরাম কে বললে তিনি তার কুঠার দিয়ে মাতৃ হত্যা করেন। এই দেখে জমদগ্নি তাকে বর দিতে চায়। এবং পরশুরাম বর হিসাবে সবার প্রাণ ফেরত চান।  জমদগ্নি সবাইকে প্রাণ ফিরিয়ে দেন। 

৯.অত্রি

অত্রি ছিলেন পুরাণে বর্ণিত একজন বৈদিক মুনি৷অত্রি মুনি অনুসূয়া দেবীর সহিত বিবাহ করেন এবং ক্রমে তাদের দুর্বাসাদত্তাত্রেয় এবং চন্দ্র নামে তিন সন্তান জন্ম নেয়৷জ্যোতিষ গণনা অনুসারে সপ্তর্ষিমণ্ডলের নক্ষত্রগুলির মধ্যে তিনি অন্তিম এবং ব্রহ্মার জিহ্বার অংশ থেকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করা হয়৷ তার স্ত্রী অনুসূয়া ছিলেন সপ্ত পতিব্রতা নারীর একজন৷ তার নিষ্ঠা ও কঠোর তপস্যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তি হিসাবে আলোচিত ব্রহ্মাবিষ্ণু ও মহেশ্বর একযোগে তার সামনে আবির্ভূত হন এবং তাদের বর দান করেন৷ আশীর্বাদ স্বরূপ তিনি ত্রিদেবকে নিজের পুত্র রূপে পান৷

১০. পুলস্ত্য

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, পুলস্ত্য ছিলেন ব্রহ্মার দশ মানষপুত্র তথা দশ প্রজাপতির একজন৷মহাভারত অনুসারে, রাক্ষসকুল এবং কিন্নরকুল উভয়ই ছিলেন মুনি পুলস্ত্যেরই সন্তান৷ তার পুত্র ছিলেন ঋষি বিশ্রবা এবং বিশ্রবাপুত্র অর্থাৎ তার পৌত্ররা ছিলেন ধনদেবতা কুবের এবং রামায়ণে প্রধান খলচরিত্র রাবণ ইত্যাদি৷ যক্ষরাও পুলস্ত্য মুনির ঔরসজাত বলে মনে করা হয় পুলস্ত্য মুনি ঋষি কর্দমের নবকন্যার মধ্যে একজনকে পত্নী হিসাবে গ্রহণ করেন, যিনি হবির্ভূ নামে পরাচিত ছিলেন৷ পুলস্ত্যপুত্র বিশ্রবার দুই পত্নী ছিলেন যথা দেববর্ণিনী এরং নিকষা৷ দেববর্ণিনীর পুত্র কুবের হলেন ধনদেবতা এবং নিকষা পুত্র রাবণকুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ ছিলেন রাক্ষস এছাড়া তার শূর্পণখা নামে একটি রাক্ষসী কন্যাও ছিলো৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *