বারো মাসে তেরো পার্বণ


বারো মাসে তেরো পার্বণ বাঙালিরা সারা বছর ধরে পালন করে। বাঙালির ঘরে ঘরে, বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। বৈশাখ থেকে শুরু, শেষ হয় চৈএ মাস। প্রত্যেকটা উৎসবই কিছু না কিছু মাঙ্গলিক বার্তা বহন করে। খুবই নিয়ম নিষ্ঠা মেনে আমরা বাঙ্গালীরা এইসব অনুষ্ঠান উৎসব পালন করা হয়।

বারো মাসে তেরো পার্বণ গুলো কি কি??

১..নবর্বষ—বৈশাখের ১ তারিখ।।

২..জামাইষষ্ঠী—জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে।।

৩..রর্থযাএা—আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে।।

৪..মনসা পূজা—শ্রাবণ মাসে শেষ দিনে।।

৫..জন্মষ্টমী—ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে।।

৬..বিশ্বকর্মা—ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন।।

৭..দূর্গাপূজা—আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে।।

৮..ভাই ফোঁটা—কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে।।

৯..নবান্ন—অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর।।

১০..পৌষ পার্বণ—পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে।।

১১..স্বরসতী পূজা—মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে।।

১২..হোলি—ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে।।

১৩..চড়ক পূজা—চৈত্রের শেষ দিনে 

                 ১.বাংলা নবর্বষ


বারো মাসে তেরো পার্বণ প্রথম মাসের বৈশাখের ১ তারিখে বাংলা নবর্বষ পালন করা হয়।।বাংলা নবর্বষ বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম সামাজিক উৎসব । সকল বাঙলীর কাছেই এটাই  প্রিয় এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পহেলা বৈশাখে বাঙালীরা বহুযুগ ধরে বর্ণাঢ্য আচার আনুষ্ঠানিকতায় বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করে থাকে। ঐতিহ্যমন্ডিত খাবার গ্রামে-গঞ্জে-নগরে লোকজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, শোভাযাত্রা ইত্যাদিতে বর্ষবরণ ‍উৎসব ভরপুর থাকে ।। পহেলা বৈশাখ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের  কাছেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শুভ হালখাতা’র আয়োজন করেন তাঁরা। ভোক্তা এবং মিষ্টিমুখ করানো শুভ হালখাতার গ্রাহকদের উপহার দেওয়া অন্যতম লোকাচার। এ উপলক্ষে হিসেবের নতুন খাতা খোলেন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।

         ২.জামাই ষষ্ঠী

জৈষ্ঠ্য মাসে অর্থাৎজামাই ষষ্ঠী পালন করা হয় ।জামাইকে ডেকে এনে সমাদার করা ও কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে মা ষষ্ঠীকে জুরে দিয়ে উৎসবের নাম হয় জামাই ষষ্ঠী।জামাই ষষ্ঠী মাসে বাঙালীর কাছে কার্যত উৎসব।
বারো মাসে তেরো পার্বণ দ্বিতীয় মাসে জৈষ্ট্য মাসে জামাই ষষ্ঠী হয়।জামাই হলো মেয়ের বর।এমন দিনে জামাই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে মিষ্টির ঝোলা ও বিশাল মাছ নিয়ে হাজির হয় শুশুরবাড়ি।এখানেই শেষ নয়, ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পুজোর জামাই ষষ্ঠী!|উপকরণ সাজাতে হয়।

পাখার উপর আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মনঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল ।করমচা-সহ পাঁচ থেকে সাত বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার উপর সাজিয়ে রাখতে হয় শাশুড়িকে।আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি নানা ফলের সমারোহ।তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীর পূজা করেন ৷ নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে প্রথমে বসিয়ে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। তেল-হলুদে চোবানো সুতো হাতের কবজিতে বেঁধে দেন মা ষষ্ঠীর স্মারক ৷ আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন।শুধুই জামাই নয়, মেয়েও কিন্তু বস্ত্রাদি উপহার হিসাবে পেয়ে থাকে ৷

                    ৩.রথযাত্রা

প্রধান ধর্মীয় হিন্দুদের রথযাত্রা অন্যতম উৎসব।অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। এই অনুষ্ঠান হয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে, একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা ফিরতি রথ।রথ ইসকনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। ।একেই বলে উল্টা রথ। এতে রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করে রথ চালানো হয়।

ভারতীয় রাজ্য রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। দেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির মাহেশ কলকাতা ও রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ দেশের সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি সর্বসমক্ষে বের করা হয়। তার পর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনও কোনও জায়গায় একটি সুসজ্জিত সুবৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজার পরে রথ টানা হয়। পুরীতে যে রথ টানার অনুষ্ঠান তাতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হতে দেখা যায়।

                ৪.মনসা পুজা

মনসা সাপের দেবী। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
বারো মাসে তেরো পার্বণ মধ্যে মা মনসা পূজা পালন করা হয়।

তিনি মূলত লৌকিক দেবী। পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবী রূপে স্বীকৃত হন।  তিনটি কারণে এই মহাদেবীর নাম হয় মনসা।  জরৎকারু, জগদ্গৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী,নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা।মনসা শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় মনে চিন্তন।প্রথমত তিনি কশ্যপ মুনির মানস কন্যা, দ্বিতীয়ত মনুষ্যগণের মনই তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্র, তৃতীয়ত তিনি নিজেও মনে মনে বা যোগবলে পরমাত্মার ধ্যান করেন। মনসার দ্বাদশটি নাম আছে।   

সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু নিজে যখন খায় তাতে বিষ লাগে না। কিন্তু হিংসায় বা আত্মরক্ষায় যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনে বিষ হলো হিংসা ক্রোধ, লোভ এগুলো দূর করার দেবী মনসা। চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই তবু চিন্তা যাতে যুক্ত হতে পারে, চিন্তা যাতে রিপুর বশ না হয় তার চেষ্টাই আমাদের করতে হবে-এই শিক্ষাই দিয়েছেন দেবী মনসা।

              ৫.জন্মাষ্টমী

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনটি আজও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতেজন্মাষ্টমী

পালন করা হয়। জন্মাষ্টমী te পুজো-পার্বণের সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা লৌকিক আচার অনুষ্ঠানও।পুজোর মধ্যে আছে লোকাচার। যেমন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, নাড়ি কাটা ইত্যাদি। পুজো শেষ হয় গভীর রাতে। প্রতিটি বিগ্রহ স্নান করিয়ে সেগুলির অভিষেক করা হয়। পরের দিন হয় নন্দোৎসব। সকাল থেকেই নিবেদন করা হয় নানা ধরনের ভোগ জন্মাষ্টমীর বিশেষ ভোগে থাকে তালের বড়া, লুচি, সুজি, পায়েস, মালপোয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি। পরের দিন সাড়ম্বরে পালিত হয় নন্দোৎসব।জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সারা দিন হয় নাম সংকীর্তন। শৈশবাবস্থার কথা ভেবেই রুপোর তৈরি বিভিন্ন খেলনা দেওয়া হয়। ১০০৮টি তুলসীপাতা চন্দন মাখিয়ে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।

                  ৬.বিশ্বকর্মা

ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে বিশ্বকর্মা পূজা করা হয়। বিশ্বকর্মা হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আশিস কামনায় এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর আকৃতি অনেকটা কার্তিকের মতো।ভক্তদের বিশ্বাস মতে তিনি বিশ্বের তাবৎ কর্মের সম্পাদক।বেদে বিশ্বকর্মাকে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তারূপে বর্ণনা করা হয়েছে।  তিনি শিল্পসমূহের প্রকাশক, অলঙ্কার শিল্পের স্রষ্টা, দেবতাদের গমনাগমনের জন্য বিমান নির্মাতা ইত্যাদি।জনশ্রুতি আছে যে, পুরীর প্রসিদ্ধ জগন্নাথমূর্তিও বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেন।রামায়ণে বর্ণিত শোভা ও সম্পদবিশিষ্ট অপূর্ব লঙ্কা নগরীর নির্মাতা বিশ্বকর্মা ।বিশ্বকর্মা স্থাপত্য,উপবেদ ও চতুঃষষ্টিকলারও প্রকাশক দেবতা। দেবশিল্পিরূপে তিনি দেবপুরী, দেবাস্ত্র ইত্যাদিরও নির্মাতা।

ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে কলকারখানায় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে বিশ্বকর্মার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দেব-দেবীর মতোই মূর্তি গড়ে অথবা ঘটে-পটে বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। সূতার-মিস্ত্রিদের মধ্যে এঁর পূজার প্রচলন সর্বাধিক।

                 ৭.দুর্গাপূজা

বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা।দুর্গা পৌরাণিক দেবতা।

বারো মাসে তেরো পার্বণ এর মধ্যে সব থেকে বড় উৎসব।

তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। । জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলা হয়।ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব জন্মে । স্বর্গরাজ্য দখল করার পর রাজ্যহারা সব দেবতারা বিষ্ণুর কাছে যান। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা।দেবতাদের শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেন।  দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তাঁর নাম হয় দুর্গা।তাই দেবীর এক নাম হয় মহিষমর্দিনী। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে। কালীবিলাসতন্ত্র, কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দুর্গোৎসববিবেক, দুর্গোৎসবতত্ত্ব  প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।যেমন কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে দেবীর পূজা ও উৎসব পালিত হয়।

                 ৮.ভাইফোঁটা

ভাইদের মঙ্গল কামনায় উন্মুখ বোনের হৃদয়ের মাঙ্গলিক নানা অনুষ্ঠানে ধরা দেয় ভাইফোঁটায় ।সাধারনত ভাইরা বোনেদের কাছে এসে চন্দন চর্চিত ফোটা নেয়।

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা

যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা

আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা

বোন ছোট হলে দাদা আর্শীবাদ করে থাকেন। বোন বড় হলে আদরের ভাইকে ফোঁটার সাথে ভাইকে উপহার দেয়া হয়ে থাকে  সাধারণত প্রদীপ জালিয়ে,উলুধ্বনি দিয়ে মাঙ্গলিক পরিবেশে অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। সবশেষে ভাইকে মিষ্টি খাইয়ে, প্রণাম ও আর্শীবাদ দেয়ানেয়ার মধ্যে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে ।

                 ৯.নবান্ন উৎসব

কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু।অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা।নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ কৃষাণীরা।ধান ঘরে উঠলে পিঠে পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। 

অগ্রহায়ণের শুরুতেই আমাদের গ্রাম বাংলায় চলে নানা উৎসব, নানা আয়োজন। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক নানা রকম খাবার।নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব।সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম।নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। যেহেতু নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব তাই প্রতি বছর ঘুরেফিরে আসে নবান্ন উৎসব।

                           ১০.পৌষ সংক্রান্তির

বাংলা পঞ্জিকা বর্ষ অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনে পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয়।বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে পৌষের শেষ দিন মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তির দিন। পৌষ সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। মকর সংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘উত্তরায়ণের সূচনা’ হিসেবে পরিচিত। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আর পৌষ-পার্বণ মানেই বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠা উৎসবের ধুম। প্রাচীনকাল থেকেই এ দিনটিতে গ্রামাঞ্চলে বসে মেলা, ঘরে ঘরে চলে নতুন চালের পিঠা-পায়েসের আয়োজন।  এদিন ঘরে ঘরে আয়োজন করা হয় নানা রকম খাবার। সংক্রান্তির দিনে বাংলার প্রতিটি ঘরেই গৃহিণীরা নতুন চালের বিভিন্ন নকশা ও সুস্বাদু পিঠে তৈরি করেন।

                 ১১.সরস্বতী

প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্বেতশুভ্র কল্যাণময়ী বিদ্যাদেবীর বন্দনা করা হয়। ঐশ্বর্যদায়িনী, বুদ্ধিদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী, সিদ্ধিদায়িনী, মোক্ষদায়িনী এবং শক্তির আধার হিসেবে সরস্বতী দেবীর আরাধনা করা হয়।সরস্বতী দেবী শ্বেতশুভ্র বসনা। দেবীর এক হাতে বেদ, অন্য হাতে বীণা। এজন্য তাকে বীণাপানিও বলা হয়। 

বারো মাসে তেরো পার্বণ এর মধ্যে স্বরসতী পূজা ছাএ-ছাএীরা বিদ্যা অর্জনের জন্য পূজা করে।

প্রনাম মন্ত্রঃ

নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।

বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

                  ১২.দোলযাত্রা 

জ্ঞান ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তার আশীর্বাদের মাধ্যমে মানুষের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে প্রতি বছর আবির্ভূত হন ভক্তদের মাঝে।শিক্ষার্থীরাই এ পূজায় বেশি মনোযোগী হয়। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঘরে ঘরে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।দোলযাত্রা একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। । এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। 

এ দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন।আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।দিন দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এর পর ভক্তেরা গুলাল ও আবির নিয়ে পরস্পর রঙ খেলেন আনন্দে। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়।এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত। এ ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। দোলযাত্রার দিন সকাল বেলা রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ গুলালে ও আবির মাখিয়ে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন গেয়ে শোভাযাত্রায বের করা হয়। 

উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়। হোলি নামটা এসেছে ‘হোলিকা’ থেকে। প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ছিল দুই ভাইবোন দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা।। হিরণ্যকশিপু অপরাজেয় হবার বর পেয়েছিলেন। তিনি কোন দেবতাকেই মানত না। বলত পুজো তাকেই করতে হবে। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর যে পুত্র ছিলেন প্রহ্লাদ নামে তিনি বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদ তার বাবার আদেশ মানতে রাজি নয়। হিরণ্যকশিপু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নানা ভাবে প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কাজ হল না। পরে প্রহ্লাদকে ভুলিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসানো হল। নিজে গায়ে দিল অগ্নি-নিরোধক শাল। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠতেই সেই শাল উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদকে ঢেকে ফেলল। অগ্নিদগ্ধ হল হোলিকা। তাঁর হাতে নিহত হল হিরণ্যকশিপু। এ আগুন অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় । পরের দিন পালিত হয় হোলি হোলিকা দগ্ধ হওয়ার পর।

               ১৩. চড়ক পুজা

 চড়ক পুজো চৈত্র মাসের শেষ দিন বা চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয়। নববর্ষের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে।

এই পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপুজোরই রকমফের এবং আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এই পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পুজোর বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পুজো করা। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়।

বার মাসে তেরো পার্বণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *